Header Ads


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৫ টি সেরা কবিতা । রবীন্দ্র জয়ন্তী | Best Poems of Rabindranath Tagore | Rabindra Jayanti

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৫ টি সেরা কবিতা । রবীন্দ্র জয়ন্তী | Best Poems of Rabindranath Tagore | Rabindra Jayanti








রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৫ টি সেরা কবিতা । রবীন্দ্র জয়ন্তী,  Best Poems of Rabindranath Tagore,  Rabindra Jayanti



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৫ টি সেরা কবিতা । রবীন্দ্র জয়ন্তী | Best Poems of Rabindranath Tagore | Rabindra Jayanti



১৪০০ সাল

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহলভরে--
 আজি হতে শতবর্ষ পরে।
আজি নববসন্তের প্রভাতের আনন্দের
লেশমাত্র ভাগ--
আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান,
আজিকার কোনো রক্তরাগ
অনুরাগে সিক্ত করি পারিব না পাঠাইতে
তোমাদের করে
আজি হতে শতবর্ষ পরে।

তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার
বসি বাতায়নে
সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি
ভেবে দেখো মনে--
 একদিন শতবর্ষ আগে
চঞ্চল পুলকরাশি কোন্‌ স্বর্গ হতে ভাসি
 নিখিলের মর্মে আসি লাগে--
নবীন ফাল্গুনদিন সকল বন্ধনহীন
উন্মত্ত অধীর--
উড়ায়ে চঞ্চল পাখা পুষ্পরেণুগন্ধমাখা
দক্ষিণসমীর--
সহসা আসিয়া ত্বরা রাঙায়ে দিয়েছে ধরা
যৌবনের রাগে
তোমাদের শতবর্ষ আগে।
সেদিন উতলা প্রাণে, হৃদয় মগন গানে,
কবি এক জাগে--
কত কথা পুষ্পপ্রায় বিকশি তুলিতে চায়
কত অনুরাগে
একদিন শতবর্ষ আগে।
আজি হতে শতবর্ষ পরে
এখন করিছে গান সে কোন্‌ নূতন কবি
তোমাদের ঘরে?
আজিকার বসন্তের আনন্দ-অভিবাদন
পাঠায়ে দিলাম তাঁর করে।
আমার বসন্তগান তোমার বসন্তদিনে
ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে
হৃদয়স্পন্দনে তব ভ্রমরগুঞ্জনে নব
পল্লবমর্মরে
আজি হতে শতবর্ষ পরে।

***


অন্তর্যামী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এ কী কৌতুক নিত্যনূতন
 ওগো কৌতুকময়ী,
আমি যাহা কিছু চাহি বলিবারে
 বলিতে দিতেছ কই।
অন্তরমাঝে বসি অহরহ
মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ,
মোর কথা লয়ে তুমি কথা কহ
 মিশায়ে আপন সুরে।
কী বলিতে চাই সব ভুলে যাই,
তুমি যা বলাও আমি বলি তাই,
সংগীতস্রোতে কূল নাহি পাই,
 কোথা ভেসে যাই দূরে।
বলিতেছিলাম বসি এক ধারে
আপনার কথা আপন জনারে,
শুনাতেছিলাম ঘরের দুয়ারে
 ঘরের কাহিনী যত--
তুমি সে ভাষারে দহিয়া অনলে
ডুবায়ে ভাসায়ে নয়নের জলে
নবীন প্রতিমা নব কৌশলে
 গড়িলে মনের মতো।

সে মায়ামুরতি কী কহিছে বাণী,
কোথাকার ভাব কোথা নিলে টানি--
আমি চেয়ে আছি বিস্ময়ে মানি
 রহস্যে নিমগন।
এ যে সংগীত কোথা হতে উঠে,
এ যে লাবণ্য কোথা হতে ফুটে,
এ যে ক্রন্দন কোথা হতে টুটে
 অন্তরবিদারণ।
নূতন ছন্দ অন্ধের প্রায়
ভরা আনন্দে ছুটে চলে যায়,
নূতন বেদনা বেজে উঠে তায়
 নূতন রাগিণীভরে।
যে কথা ভাবি নি বলি সেই কথা,
যে ব্যথা বুঝি না জাগে সেই ব্যথা,
জানি না এনেছি কাহার বারতা
 কারে শুনাবার তরে।
কে কেমন বোঝে অর্থ তাহার,
কেহ এক বলে কেহ বলে আর,
আমারে শুধায় বৃথা বার বার
 দেখে তুমি হাস বুঝি।
কে গো তুমি, কোথা রয়েছ গোপনে,
 আমি মরিতেছি খুঁজি।

এ কী কৌতুক নিত্যনূতন
 ওগো কৌতুকময়ী।
যে দিকে পান্থ চাহে চলিবারে
 চলিতে দিতেছ কই।
গ্রামের যে পথ ধায় গৃহপানে,
চাষিগণ ফিরে দিবা-অবসানে,
গোঠে ধায় গোরু, বধূ জল আনে
 শত বার যাতায়াতে,
একদা প্রথম প্রভাতবেলায়
সে পথে বাহির হইনু হেলায়--
মনে ছিল, দিন কাজে ও খেলায়
 কাটায়ে ফিরিব রাতে।
পদে পদে তুমি ভুলাইলে দিক,
কোথা যাব আজি নাহি পাই ঠিক,
ক্লান্তহৃদয় ভ্রান্ত পথিক
 এসেছি নূতন দেশে।
কখনো উদার গিরির শিখরে
কভু বেদনার তমোগহ্বরে
চিনি না যে পথ সে পথের 'পরে
 চলেছি পাগল-বেশে।
কভু বা পন্থ গহন জটিল,
কভু পিচ্ছল ঘনপঙ্কিল,
কভু সংকটছায়াশঙ্কিল,
 বঙ্কিম দুরগম--
খরকণ্টকে ছিন্ন চরণ,
ধুলায় রৌদ্রে মলিন বরন,
আশেপাশে হতে তাকায় মরণ
 সহসা লাগায় ভ্রম।
তারি মাঝে বাঁশি বাজিছে কোথায়,
কাঁপিছে বক্ষ সুখে ব্যথায়,
তীব্র তপ্ত দীপ্ত নেশায়
 চিত্ত মাতিয়া উঠে।
কোথা হতে আসে ঘন সুগন্ধ,
কোথা হতে বায়ু বহে আনন্দ,
চিন্তা ত্যজিয়া পরান অন্ধ
 মৃত্যুর মুখে ছুটে।

খেপার মতন কেন এ জীবন,
অর্থ কী তার, কোথা এ ভ্রমণ,
চুপ করে থাকি শুধায় যখন--
 দেখে তুমি হাস বুঝি।
কে তুমি গোপনে চালাইছ মোরে
 আমি যে তোমারে খুঁজি।

রাখো কৌতুক নিত্যনূতন
 ওগো কৌতুকময়ী।
আমার অর্থ তোমার তত্ত্ব
 বলে দাও মোরে অয়ি।
আমি কি গো বীণাযন্ত্র তোমার,
ব্যথায় পীড়িয়া হৃদয়ের তার
মূর্ছনাভরে গীতঝংকার
 ধ্বনিছ মর্মমাঝে?
আমার মাঝারে করিছ রচনা
অসীম বিরহ, অপার বাসনা,
কিসের লাগিয়া বিশ্ববেদনা
 মোর বেদনায় বাজে?
মোর প্রেমে দিয়ে তোমার রাগিণী
কহিতেছ কোন্‌ অনাদি কাহিনী,
কঠিন আঘাতে ওগো মায়াবিনী
 জাগাও গভীর সুর।
হবে যবে তব লীলা-অবসান,
ছিঁড়ে যাবে তার, থেমে যাবে গান,
আমারে কি ফেলে করিবে প্রয়াণ
 তব রহস্যপুর?
জ্বেলেছ কি মোরে প্রদীপ তোমার
করিবারে পূজা কোন্‌ দেবতার

রহস্য-ঘেরা অসীম আঁধার
 মহামন্দিরতলে?
নাহি জানি তাই কার লাগি প্রাণ
মরিছে দহিয়া নিশিদিনমান,
যেন সচেতন বহ্নিসমান
 নাড়ীতে নাড়ীতে জ্বলে।
অর্ধনিশীথে নিভৃতে নীরবে
এই দীপখানি নিবে যাবে যবে
বুঝিবে কি, কেন এসেছিনু ভবে,
 কেন জ্বলিলাম প্রাণে?
কেন নিয়ে এলে তব মায়ারথে
তোমার বিজন নূতন এ পথে,
কেন রাখিলে না সবার জগতে
 জনতার মাঝখানে?
জীবন-পোড়ানো এ হোম-অনল
সেদিন কি হবে সহসা সফল?
সেই শিখা হতে রূপ নির্মল
 বাহিরি আসিবে বুঝি!
সব জটিলতা হইবে সরল
 তোমারে পাইব খুঁজি।

ছাড়ি কৌতুক নিত্যনূতন
 ওগো কৌতুকময়ী,
জীবনের শেষে কী নূতন বেশে
 দেখা দিবে মোরে অয়ি!
চিরদিবসের মর্মের ব্যথা,
শত জনমের চিরসফলতা,
আমার প্রেয়সী, আমার দেবতা,
 আমার বিশ্বরূপী,

মরণনিশায় উষা বিকাশিয়া
শ্রান্তজনের শিয়রে আসিয়া
মধুর অধরে করুণ হাসিয়া
 দাঁড়াবে কি চুপিচুপি?
ললাট আমার চুম্বন করি
নব চেতনায় দিবে প্রাণ ভরি,
নয়ন মেলিয়া উঠিব শিহরি,
 জানি না চিনিব কি না--
শূন্য গগন নীলনির্মল,
নাহি রবিশশী গ্রহমণ্ডল,
না বহে পবন, নাই কোলাহল,
 বাজিছে নীরব বীণা--
অচল আলোকে রয়েছ দাঁড়ায়ে,
কিরণবসন অঙ্গ জড়ায়ে
চরণের তলে পড়িছে গড়ায়ে
 ছড়ায়ে বিবিধ ভঙ্গে।
গন্ধ তোমার ঘিরে চারি ধার,
উড়িছে আকুল কুন্তলভার,
নিখিল গগন কাঁপিছে তোমার
 পরশরসতরঙ্গে।
হাসিমাখা তব আনত দৃষ্টি
আমারে করিছে নূতন সৃষ্টি
অঙ্গে অঙ্গে অমৃতবৃষ্টি
 বরষি করুণাভরে।
নিবিড় গভীর প্রেম-আনন্দ
বাহুবন্ধনে করেছে বন্ধ,
মুগ্ধ নয়ন হয়েছে অন্ধ
 অশ্রুবাষ্পথরে।
নাহিকো অর্থ, নাহিকো তত্ত্ব,
নাহিকো মিথ্যা, নাহিকো সত্য,

আপনার মাঝে আপনি মত্ত--
 দেখিয়া হাসিবে বুঝি।
আমি হতে তুমি বাহিরে আসিবে,
 ফিরিতে হবে না খুঁজি।

যদি কৌতুক রাখ চিরদিন
 ওগো কৌতুকময়ী,
যদি অন্তরে লুকায়ে বসিয়া
 হবে অন্তরজয়ী,
তবে তাই হোক। দেবী, অহরহ
জনমে জনমে রহো তবে রহো,
নিত্যমিলনে নিত্যবিরহ
 জীবনে জাগাও প্রিয়ে।
নব নব রূপে-- ওগো রূপময়,
লুণ্ঠিয়া লহো আমার হৃদয়,
কাঁদাও আমারে, ওগো নির্দয়,
 চঞ্চল প্রেম দিয়ে।
কখনো হৃদয়ে কখনো বাহিরে,
কখনো আলোকে কখনো তিমিরে,
কভু বা স্বপনে কভু সশরীরে
 পরশ করিয়া যাবে--
বক্ষোবীণায় বেদনার তার
এইমতো পুন বাঁধিব আবার,
পরশমাত্রে গীতঝংকার
 উঠিবে নূতন ভাবে।
এমনি টুটিয়া মর্মপাথর
ছুটিবে আবার অশ্রুনিঝর,
জানি না খুঁজিয়া কী মহাসাগর
 বহিয়া চলিবে দূরে।

বরষ বরষ দিবসরজনী
অশ্রুনদীর আকুল সে ধ্বনি
রহিয়া রহিয়া মিশিবে এমনি
 আমার গানের সুরে।
যত শত ভুল করেছি এবার
সেইমতো ভুল ঘটিবে আবার--
ওগো মায়াবিনী, কত ভুলাবার
 মন্ত্র তোমার আছে!
আবার তোমারে ধরিবার তরে
ফিরিয়া মরিব বনে প্রান্তরে,
পথ হতে পথে, ঘর হতে ঘরে
 দুরাশার পাছে পাছে।
এবারের মতো পুরিয়া পরান
তীব্র বেদনা করিয়াছি পান,
সে সুরা তরল অগ্নিসমান
 তুমি ঢালিতেছ বুঝি!
আবার এমনি বেদনার মাঝে
 তোমারে ফিরিব খুঁজি।

***

 বীরপুরুষ 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে 
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে। 
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে 
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে, 
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ’পরে 
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে। 
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে 
রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।  

সন্ধে হল,সূর্য নামে পাটে 
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে। 
ধূ ধূ করে যে দিক পানে চাই 
কোনোখানে জনমানব নাই, 
তুমি যেন আপনমনে তাই 
ভয় পেয়েছ; ভাবছ, এলেম কোথা? 
আমি বলছি, ‘ভয় পেয়ো না মা গো, 
ঐ দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা।’  

চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে, 
মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে। 
গোরু বাছুর নেইকো কোনোখানে, 
সন্ধে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে, 
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে, 
অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো। 
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে, 
‘দিঘির ধারে ঐ যে কিসের আলো!’  

এমন সময় ‘হারে রে রে রে রে’ 
ঐ যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে। 
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে 
ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে, 
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে 
পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো। 
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে, 
‘আমি আছি, ভয় কেন মা কর।’  

হাতে লাঠি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল 
কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল। 
আমি বলি, ‘দাঁড়া, খবরদার! 
এক পা আগে আসিস যদি আর – 
এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার, 
টুকরো করে দেব তোদের সেরে।’ 
শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে 
চেঁচিয়ে উঠল, ‘হারে রে রে রে রে।’  

তুমি বললে, ‘যাস না খোকা ওরে’ 
আমি বলি, ‘দেখো না চুপ করে।’ 
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে, 
ঢাল তলোয়ার ঝন্‌ঝনিয়ে বাজে 
কী ভয়ানক লড়াই হল মা যে, 
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা। 
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে, 
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।  

এত লোকের সঙ্গে লড়াই করে 
ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে। 
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে 
বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে’, 
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে 
চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে – 
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল! 
কী দুর্দশাই হত তা না হলে।’  

রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা – 
এমন কেন সত্যি হয় না আহা। 
ঠিক যেন এক গল্প হত তবে, 
শুনত যারা অবাক হত সবে, 
দাদা বলত, ‘কেমন করে হবে, 
খোকার গায়ে এত কি জোর আছে।’ 
পাড়ার লোকে বলত সবাই শুনে, 
‘ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে।’

***

আমি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এই যে সবার সামান্য পথ, পায়ে হাঁটার গলি
সে পথ দিয়ে আমি চলি
সুখে দুঃখে লাভে ক্ষতিতে,
রাতের আঁধার দিনের জ্যোতিতে।
প্রতি তুচ্ছ মুহূর্তেরই আবর্জনা করি আমি জড়ো,
কারো চেয়ে নইকো অমি বড়ো।
চলতে পথে কখনো বা বিঁধছে কাঁটা পায়ে,
লাগছে ধুলো গায়ে;
দুর্বাসনার এলোমেলো হাওয়া,
তারি মধ্যে কতই চাওয়া পাওয়া,
কতই বা হারানো,
খেয়া ধরে ঘাটে আঘাটায়
নদী-পারানো।
এমনি করে দিন কেটেছে, হবে সে-দিন সারা
বেয়ে সর্বসাধারণের ধারা।
শুধাও যদি সবশেষে তার রইল কী ধন বাকী,
স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারি তা কি!
জানি, এমন নাই কিছু যা পড়বে কারো চোখে,
স্মরণ-বিস্মরণের দোলায় দুলবে বিশ্বলোকে।
নয় সে মানিক, নয় সে সোনা,--
যায় না তারে যাচাই করা, যায় না তারে গোনা।
এই দেখো-না শীতের রোদের দিনের স্বপ্নে বোনা
সেগুন বনে সবুজ-মেশা সোনা,
শজনে গাছে লাগল ফুলের রেশ,
হিমঝুরির হৈমন্তী পালা হয়েছে নিঃশেষ।
বেগনি ছায়ার ছোঁওয়া-লাগা স্তব্ধ বটের শাখা
ঘোর রহস্যে ঢাকা।
ফলসা গাছের ঝরা পাতা গাছের তলা জুড়ে
হঠাৎ হাওয়ায় চমকে বেড়ায় উড়ে।
গোরুর গাড়ি মেঠো পথের তলে
উড়তি ধুলোয় দিকের আঁচল ধূসর ক'রে চলে।
নীরবতার বুকের মধ্যখানে
দূর অজানার বিধুর বাঁশি ভৈরবী সুর আনে।
কাজভোলা এই দিন
নীল আকাশে পাখির মতো নিঃসীমে হয় নীল।
এরি মধ্যে আছি আমি,
সব হতে এই দামি।
কেননা আজ বুকের কাছে যায় না জানা,
আরেকটি সেই দোসর আমি উড়িয়ে চলে বিরাট তাহার ডানা
জগতে জগতে
অন্তবিহীন ইতিহাসের পথে।
এই যে আমার কুয়োতলার কাছে
সামান্য ঐ আমের গাছে
কখনো বা রৌদ্র খেলায়, কভু শ্রাবণধারা,
সারা বয়ষ থাকে আপনহারা
সাধারণ এই অরণ্যানীর সবুজ আবরণে,
মাঘের শেষে অকারণে
ক্ষণকালের গোপন মন্ত্রবলে
গভীর মাটির তলে
শিকরে তার শিহর লাগে,
শাখায় শাখায় হঠাৎ বাণী জাগে,--
"আছি, আছি, এই যে আমি আছি।"
পুষ্পোচ্ছ্বাসে ধায় সে বাণী স্বর্গলোকের কাছাকাছি
দিকে দিগন্তরে।
চন্দ্র সূর্য তারার আলো তারে বরণ করে।
এমনি করেই মাঝে মাঝে সোনার কাঠি আনে
কভু প্রিয়ার মুগ্ধ চোখে, কভু কবির গানে--
অলস মনের শিয়রেতে কে সে অন্তর্যামী;
নিবিড় সত্যে জেগে ওঠে সামান্য এই আমি।
যে আমিরে ধূসর ছায়ায় প্রতিদিনের ভিড়ের মধ্যে দেখা
সেই আমিরে এক নিমেষের আলোয় দেখি একের মধ্যে একা।
সে-সব নিমেষ রয় কি না রয় কোনোখানে,
কেউ তাহাদের জানে বা না-ই জানে,
তবু তারা জীবনে মোর দেয় তো আনি
ক্ষণে ক্ষণে পরম বাণী
অনন্তকাল যাহা বাজে
বিশ্বচরাচরের মর্মমাঝে
"আছি আমি আছি"--
যে বাণীতে উঠে নাচি
মহাগগন-সভাঙ্গনে আলোক-অপ্সরী
তারার মাল্য পরি।

***

বিরহ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি নিশি - নিশি কত রচিব শয়ন
 আকুলনয়ন রে !
 কত নিতি - নিতি বনে করিব যতনে
 কুসুমচয়ন রে !
 কত শারদ যামিনী হইবে বিফল ,
 বসন্ত যাবে চলিয়া !
 কত উদিবে তপন আশার স্বপন ,
 প্রভাতে যাইবে ছলিয়া !
 এই যৌবন কত রাখিব বাঁধিয়া ,
 মরিব কাঁদিয়া রে !
 সেই চরণ পাইলে মরণ মাগিব
 সাধিয়া সাধিয়া রে ।
 আমি কার পথ চাহি এ জনম বাহি ,
 কার দরশন যাচি রে !
 যেন আসিবে বলিয়া কে গেছে চলিয়া ,
 তাই আমি বসে আছি রে ।
 তাই মালাটি গাঁথিয়া পরেছি মাথায়
 নীলবাসে তনু ঢাকিয়া ,
 তাই বিজন আলয়ে প্রদীপ জ্বালায়ে
 একেলা রয়েছি জাগিয়া ।
 ওগো তাই কত নিশি চাঁদ ওঠে হাসি ,
 তাই কেঁদে যায় প্রভাতে ।
 ওগো তাই ফুলবনে মধুসমীরণে
 ফুটে ফুল কত শোভাতে !
 
 
 ওই বাঁশিস্বর তার আসে বার বার ,
 সেই শুধু কেন আসে না !
 এই হৃদয় - আসন শূন্য যে থাকে ,
 কেঁদে মরে শুধু বাসনা ।
 মিছে পরশিয়া কায় বায়ু বহে যায় ,
 বহে যমুনার লহরী ,
 কেন কুহু কুহু পিক কুহরিয়া ওঠে —
 যামিনী যে ওঠে শিহরি ।
 ওগো যদি নিশিশেষে আসে হেসে হেসে ,
 মোর হাসি আর রবে কি !
 এই জাগরণে ক্ষীণ বদন মলিন
 আমারে হেরিয়া কবে কী !
 আমি সারা রজনীর গাঁথা ফুলমালা
 প্রভাতে চরণে ঝরিব ,
 ওগো আছে সুশীতল যমুনার জল —
 দেখে তারে আমি মরিব ।
***


No comments: